আত্মীয়তার বন্ধনে রাজনীতি

রাজনীতিতে তারা বিপরীত আদর্শে বিশ্বাসী। জাতির ক্রান্তিকাল ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। কিন্তু সামাজিকভাবে তারা জড়িয়ে আছেন আত্মীয়তার বন্ধনে। রাজনীতিকদের আত্মীয়তার এ বন্ধন নতুন নয়। বৃটিশ আমল থেকেই এ সম্পর্ক বহমান। ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে বিখ্যাত কিছু রাজনৈতিক পরিবারের সম্পর্ক শেকড়ের মতো ছড়ানো। রাজনীতির ইতিহাসে এসব পরিবারের সদস্যরা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থাকেন সবসময়। জাতীয় রাজনীতির অনেকখানিই এখন আত্মীয় রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন বাংলাদেশ। তাদের হাতেই হাতবদল হয় দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা। গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পরিবার, বগুড়ার জিয়া পরিবার, রংপুরের এরশাদ পরিবার, চট্টগ্রাম ও সিলেটের কয়েকটি চৌধুরী পরিবার, বরিশালের খান ও সেরনিয়াবাত পরিবার, চট্টগ্রামের খান ও সিদ্দিকী পরিবার, ফরিদপুরের চৌধুরী ও কবির পরিবার, রাজশাহীর জামান পরিবার, টাঙ্গাইলের সিদ্দিকী, খান ও পন্নী পরিবার, পাবনার মির্জা পরিবার, সিরাজগঞ্জের মাহমুদ পরিবার ও নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারই এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। সাম্প্রতিক রাজনীতিতে বিপরীত আদর্শের প্রতি অসহিষ্ণুতা বাড়লেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন আত্মীয়তার বন্ধন।

মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি ও নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে ওঠা শেখ মুজিবের পারিবারিক আত্মীয়তা ছিল গোটা দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে। পরে তা বিস্তৃত হয়েছে গোটা বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা। একমাত্র মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তার স্বামী খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতু বর্তমান সরকারের শ্রম ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ফরিদপুর-৩ আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে। ফলে শেখ হাসিনা ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ সম্পর্কে বেয়াই-বেয়াইন। এ সম্পর্কের মাধ্যমে শেখ ও খন্দকার পরিবারের মধ্যে পুরানো সম্পর্ক পেয়েছে নতুন মাত্রা। পুতুলের দাদা শ্বশুর খন্দকার নুরুল হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই। খন্দকার মোশাররফের ছোট ভাই খন্দকার মোহতাশিম হোসেন হলেন ফরিদপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ননদের স্বামী হলেন সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগদলীয় এমপি ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না। আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়া। ওয়াজেদ মিয়ার বড় বোনের নাতনি হলেন আওয়ামী লীগ সরকারের হুইপ গাইবান্ধা-২ আসনের এমপি মাহবুব আরা গিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে হলেন শেখ রেহানা। তার মেয়ে হলেন টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। যিনি বৃটেনের ৫৬তম জাতীয় নির্বাচনে হ্যামপস্টেড এবং কিলবার্ন আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন লেবারদলীয় এমপি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের আরেক আত্মীয় হলেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভানেত্রী ও জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান। আইভী রহমান হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার খালা শাশুড়ি। সে হিসেবে জিল্লুর রহমান হলেন শেখ হাসিনার তালই। আবার জিল্লুর রহমান ও আইভী রহমানের সন্তান হলেন ভৈরব-কুলিয়ারচর আসনের আওয়ামী লীগদলীয় এমপি ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।

বঙ্গবন্ধুর বোন আছিয়া বেগমের দুই ছেলে হলেন শেখ ফজলুল হক মণি ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সম্পর্কে তারা শেখ হাসিনার আপন ফুফাতো ভাই। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকদের হাতে শহীদ হন। তার ছেলে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপস ঢাকা-১০ আসন-এর এমপি। বঙ্গবন্ধুর আরেক ভাগনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম হলেন সাবেক মন্ত্রী ও গোপালগঞ্জ-২ আসনের এমপি। শেখ সেলিমের বোনের স্বামী হলেন বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা ও এরশাদ সরকারের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুর। যিনি পরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দেন। মঞ্জুর সম্পর্কে শেখ হাসিনার ফুফাতো বোনের স্বামী। আবার মঞ্জুর দুই ছেলে বিজেপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ ও ড. আশিকুর রহমান শান্ত। বর্তমানে তারা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়। শেখ হাসিনা সম্পর্কে তাদের খালা। আবার শেখ সেলিমের ছেলে বিয়ে করেছেন বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর মেয়েকে। ওয়ান ইলেভেনের সময় তাদের পরিচয়পর্ব আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পারিবারিক আয়োজনে পরিণয়ে পরিণত হয়। অবশ্যই ইকবাল হাসান টুকু ছাত্র জীবনে বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্য পুত্র শেখ কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠি ছিলেন। শেখ সেলিমের আরেক ছেলে বিয়ে করেছেন আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের মেয়েকে। এই মুসা বিন শমসেরের ছেলে ববি হাজ্জাজ হলেন এরশাদের সাবেক মুখপাত্র ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা।

বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের। তার ছেলে হলেন বাগেরহাট-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি শেখ হেলাল। তার মেয়ের জামাই হলেন ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ। শেখ সেলিম ব্যারিস্টার পার্থের মামা ও শেখ হেলাল পার্থের শ্বশুর। আবার শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ মণি ও শেখ সেলিমের আরেক ছোট বোনের জামাই হলেন যুবলীগের বর্তমান সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। আর শেখ সেলিমের ভায়রা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী জামালপুর-১ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদ।

বঙ্গবন্ধুর বড় বোনের জামাই হলেন আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আবদুর রব সেরনিয়াবাত। সেরনিয়াবাতের ছেলে হলেন জাতীয় সংসদের সাবেক চিফ হুইপ বরিশাল-১ আসনের আওয়ামী লীগদলীয় এমপি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। শেখ হাসিনা ও হাসানাত আবদুল্লাহ পরস্পরের মামাতো-ফুফাতো ভাই-বোন। আবার হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট বোনের দেবর হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কুষ্টিয়া-৩ আসনের এমপি মাহবুবুল আলম হানিফ। তিনি সম্পর্কে শেখ হাসিনার বেয়াই। আবার হাসানাত আবদুল্লাহর সম্পর্কে চাচাতো ভাই হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। শেখ হাসিনার আরেক ফুফাতো ভাই হলেন মাদারীপুরের সাবেক এমপি প্রয়াত ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী। ইলিয়াস চৌধুরীর বড় ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক হুইপ ও মাদারীপুর-১ আসনের এমপি। ইলিয়াস চৌধুরীর ছোট ছেলে মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র এমপি। সে হিসেবে লিটন ও নিক্সন চৌধুরী সম্পর্কে শেখ হাসিনার ভাতিজা। শেখ হাসিনার সম্পর্কে আরেক ফুফাতো ভাই হলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাদারীপুর-৩ আসনের এমপি বাহাউদ্দিন নাছিম। শেখ হাসিনার চাচা সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লি. এর চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেনের বেয়াই হলেন বিএনপির দীর্ঘ সময়ের মহাসচিব এবং ওয়ান ইলেভেনের সংস্কারপন্থি শীর্ষ নেতা প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। মান্নান ভূঁইয়ার ছেলের সঙ্গে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়েছে শেখ কবিরের মেয়ের। সে হিসেবে শেখ হাসিনার সম্পর্কে তালই হলেন মান্নান ভূঁইয়া।

বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে ফরিদপুরের বিখ্যাত লাল মিয়া-মোহন মিয়া পরিবারের। ফরিদপুরের আবাদ আল্লা জহিরউদ্দিন লাল মিয়ার পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো বোন মোসাম্মাৎ বেগমের মেয়ে বিয়ে করেছেন লাল মিয়ার বড় ছেলে চৌধুরী মমতাজ হোসেন রাজা মিয়া। বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভগ্নিপতি গোলাম গফুর চৌধুরী ছিলেন ফরিদপুরের খ্যাতিমান আইনজীবী। সেই সঙ্গে শেখ হাসিনার বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের সঙ্গে দ্বিমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে এ লাল মিয়া-মোহন মিয়া পরিবারের। পুতুলের শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেনের আপন বোন বিয়ে করেছেন পাকিস্তান আমলের ডাকসাইটে নেতা মন্ত্রী মরহুম ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়ার ছেলে।

এছাড়া শেখ হাসিনার সম্পর্কে ফুফা হলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ঝালকাঠি-২ আসনের এমপি আমির হোসেন আমু। তার স্ত্রী প্রয়াত ফিরোজা হোসেন সম্পর্কে শেখ হাসিনার ফুফু। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব প্রয়াত শেখ শহীদুল ইসলাম আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার খালাতো ভাই। শেখ শহীদুল ইসলাম ছিলেন এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী। শেখ হাসিনার দূরসম্পর্কের ফুফা হলেন লে. জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান বীরবিক্রম। সূত্র : মানবজমিন

আগামীকাল পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব



মন্তব্য চালু নেই