আজ খুব বেশি প্রয়োজন বিদ্রোহী কবি নজরুলকে অনুশীলন

মো. আলী আশরাফ খান : আজকে আমরা খুব বেশি প্রয়োজন বলে মনে করছি, আমাদের জাতীয় ও বিদ্রোহী খ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অনুশীলন। শুধু তাই নয়, আমরা মনে করি তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী জীবনী এবং সৃষ্টিশীল কর্মই আমাদের জাতীয় জীবন তথা বৈশ্বিক পর্যায়ে যাবতীয় পতিত সমস্যা হতে উত্তরণে হতে পারে বড় রকমের হাতিয়ার এবং পতিতদশা থেকে মুক্তি দিতেতাঁর দিক-নির্দেশনাসমূহ হতে পারে এক মাইলফলক।

আমরা জানি, প্রতিটি দেশ-জাতিকে দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য সময়ে সময়ে আল্লাহ তায়ালাপৃথিবীতে এমন কিছু অসামান্য প্রতিভার মানুষ প্রেরণ করেন, যাদের আলোয় মানুষ আলোকিত হয়, সমাজ থেকে দূর হয় নানা রকম কুসংস্কার-বৈষম্য, মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখে এবং মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বিশ্বমাঝে। এমনই একজন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি আমাদের জাতি তথা বিশ্বের গৌরব-আমাদের অহংকার। সর্বোপরি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বের এক আলোকজ্যোতির নাম তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম একজন মহিমান্বিত চিরভাস্বর আলোকিত একজন মানুষ। যার আলোয় দেশ-জাতি-বিশ্ব হয়েছে আলোকিত। যদিও পৃথিবীর এক ব্যতিক্রম পরিক্রমায় বিরল প্রতিভাধর এই কবির জন্ম। তারপরেও তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, মানুষ যদি ইচ্ছে করে ¯্রষ্টার দেয়া শক্তি দ্বারা ভাল কিছু সৃষ্টি করতে পারে অনায়াসে। স্থান-কাল, বংশ ও জাতি মানুষের মেধার উৎস নয়, মানুষের পরিচয় ও মেধা বিকশিত হয় তার চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে। ইতিহাস স্বাক্ষী, বিশ্ব যখন এক নাজুক অবস্থায় পর্যবসিত হয়েছিল, মানুষ কঠোর ও কঠিন সময় করেছিল অতিবাহিত ঠিক ওইসময়ে নজরুল অতি সাধারণ ঘরে জন্ম নেন। যখন মানুষ ন্যায়-নীতিকে পদাঘাত করে অসুন্দরকে মাথা পেতে নেয় এবং কিছু ব্যক্তি-পরিবার, সমাজ ও দেশ-জাতি সর্বোপরি উপনিবেশকতার পেশিশক্তিতে মানুষ হয় নিস্পেষিত, অবহেলিত, নির্যাতিত তখন তার জন্ম মানুষকে জানিয়ে দেয়, আর নয় পিছনে ফেরার দিন এবার বজ্রকন্ঠে আওয়াজ তুলে করো প্রতিবাদ। আর আমরা সইবোনা কারো অপশাসন-অবিচার, কারো প্রতিহিংসার অনলে আর হবো না আমরা দাহিত, করবো এবার প্রতিবাদ! প্রতিবাদ!! প্রতিবাদ!!!

শুধু তাই নয়, মানুষ যখন ন্যুজ হয়ে উন্নতমস্তককে অবনত করত এবং অশুভ শক্তি আগ্রাসিকতার কাছে হতো পরাজিত, বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে মানুষ দিগি¦দিক হারিয়ে যখন ছিল পাগলপ্রায়, সেই কঠিন সময়ে নজরুল তার বলিষ্ঠ আহ্বানে ঘুমন্ত মানুষকে জাগায় এবং সকলকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখায়। কোন বাঁধা-বিপত্তিই তাকে পারেনি কাঙিক্ষত পথ থেকে দূরে সরাতে। মানুষের মাঝে ভালবাসার অনিন্দ্য এক শক্তি সৃষ্টি করতে তার যেন কোন বিকল্প নেই। সকল মানুষের মধ্যে যেন এমন চেতনা তৈরি হয়, মন থেকে একটি সুন্দর দেশ বিনির্মাণে এগিয়ে আসে সকলে এ চেষ্টা ছিল বিদ্রোহী কবি নজরুলের মূল লক্ষ্য।

এই ক্ষণজন্মা কালোত্তীর্ণ কবির চিন্তা-চেতনায় সবসময় বিরাজ করতো দেশ-জাতিকে উন্নত করা। পাশাপাশি তিনি নিজের মধ্যে ভালত্বের সমষ্টি করণের মধ্যদিয়ে সর্বস্তরের মানুষের জীবনধারারকে সুনিব্যস্ত করেছেন কবিতা, গল্প, গানসহ বিভিন্ন লেখা। মহাকালের এই মহাকবি অতি সাধারণ ঘরে ১৮৯৯ সালে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১জ্যৈষ্ঠ জন্ম নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে সৃষ্টি করেছেন এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের। তিনি জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন প্রতিকূলতায় ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎড়াই ও কন্টকাকীর্ণতাকে মাড়িয়ে ব্যতিক্রমী এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিশেষ করে জীবনের শেষ সময়গুলোয় তিনি কাটিয়েছেন নানা রোগ-ব্যাধি এবং মানসিক কষ্ট-যন্ত্রণায়। আমাদের এই মহাকবি কখনো কারে কাছে মাথা নত করেননি।

বিরল প্রতিভাধর এ মানুষটি জন্মের পর থেকেই চ্যালেঞ্জিং জীবন যাপনে অভ্যস্ত হন। শিক্ষা জীবনের প্রথমে মক্তবে পড়া দিয়ে লেটো দলে গান গাওয়া, রুটির দোকানে চাকুরি, মসজিদে ইমামতি (?), ১৯১১ সালে মাথরুণ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়ণ, ১৯১৪ সালে দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি এবং ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীতে পড়াশোনা, ১৯১৭ সালে বাঙালি পল্টনে যোগদান, ১৯২০ সালে পল্টনে থেকে ফিরে আসা, ১৯৪২ সাল পর্যন্ত নাটক, সক্রিয়ভাবে সাহিত্যচর্চা, সঙ্গীতচর্চর্চা এবং সকলের যাতে বোধগম্য হয় ঠিক সেরকম সুনিপুণভাবে আরবি, ফারসি, তুর্কী, হিন্দি ও উর্দু শব্দের সমাহারে নান্দনিক উপস্থাপন ঘটিয়েছেন তার বিভিন্ন লেখায়। যা ছিল সাধারণ মানুষ থেকে আরাম্ভ করে উচ্চশ্রেণীর মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদরযোগ্য, পাঠযোগ্য, শ্রবণীয় এবং তার সাথে সাথে তার রাজনীতির্চ্চা ও সংবাদপত্রসেবা ছিল ইতিহাস সৃষ্টি করার মত এক ব্যাপার। নজরুল ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত জীবন্ত অবস্থায় ভারতে ও বাংলাদেশে অবস্থান করেন এবং জীবনের শেষ সময় ঢাকায় কাটান। সকল পঙ্কিলতাকে পেছনে ঠেলে ‘উন্নত মম শির’ কবি কাজী নজরুল সমগ্র বিশ্বকে কাঁদিয়ে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মাসে পরলোকগমণ করেন। আর এভাবেই মহাকালের মহাকবির বৈচিত্র্যময় জীবন অতিবাহিত হয়। তাঁর বিদ্রোহী কবিতার পংক্তিতে প্রতিয়মান হয় যে, কতটা মহান, কতটা সাহসী, কতটা সার্থক পুরুষ ছিলেন এই মানবতার মহাকবি।

এই মহাকবিকে নিয়ে এ ছোট্ট পরিসরে লেখা দুরুহ ব্যাপারই বলে মনে করি। এই বিদ্রোহী কবি বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গণে স্রষ্টারই আর্শীর্বাদ স্বরূপ পৃথিবীকে করেছেন আলোকিত। তার আগাম পদচারণা এবং বিদায় ছিল এক নাটকীয় বেশিষ্ট্যমন্ডিত ও দেদীপ্যমান। আধুনিকতায় ভরপুর ছিল তার সাহিত্য কর্ম। এই কবির কবিতার চারণিক বৈশিষ্ট্য বিষয়, বৈচিত্র্যের আভিজাত্য, শব্দ ও প্রতীক ব্যবহার পরিমিত জ্ঞান এবং কবিত্ব প্রতিভার অপূর্ব সমাহার দারুণভাবে আন্দোলিত করে বিদগ্ধজনদের। এই মহাকালের মহাকবি নজরুল ইসলাম মূলত: ২৩ বছর সাহিত্যার্চ্চা করেন। অর্থাৎ ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৪২ সাল। আর এই অল্প সময়ের মধ্যে তার সৃষ্টিসমগ্র পৃথিবীর ইতিহাস এক নজিরবিহীন ঘটনা। তাছাড়া তখন কথিত পন্ডিত মশাইয়েরা নজরুলের এ ব্যতিক্রমী জ্ঞানদ্বীপ্ততা ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে বিভিন্ন দুর্ভিসন্ধিমূলক কর্মকান্ড চালিয়েছেন অবিরামভাবে। তারপরেও কবির এসব নান্দনিক সৃষ্টিকে দাবিয়ে রাখতে পারেননি তারা। তবে এ কাজে ওইসব দুষ্টুচক্র পুরোপুরি সার্থক হতে যে পারেননি তা কিন্তু নয়, তারা কবির সৃজনশীল কর্মকান্ডকে অন্যের নামে এবং বিভিন্নভাবে লুকিয়ে রাখছেন। যা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে এবং একসময় বেরিয়ে আসবেই। এটা আমাদের দৃঢ বিশ্বাস।

কাজী নজরুল বিখ্যাত হয়েছেন যে কারণে, তিনি বরাবরই চেয়েছেন, মানুষের মধ্যে ধর্ম বিদ্বেষ থাকবে না, জাতি বিদ্বেষ থাকবে না, বর্ণ বিদ্বেষ থাকবে না এবং থাকবে না অভিজাত্য অভিমান। তিনি চেয়েছেন, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাই ভাই হয়ে সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে। তিনি চেয়েছেন, গন্ডী কাটিয়ে, সব সংকীর্ণতা, সব মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে পরিহার করে সকলে ভাইকে ভাই বলে ডেকে শান্তিময় সহবস্থান। তিনিই প্রকৃত আহ্বান করেছেন সব মানুষকে একই পতাকা তলে সমবেত হয়ে সুস্থ-সুন্দর ও উন্নত সুশীতল শান্তিময় সমাজ উপহার দিতে। তার এই উন্নত চিন্তা ও সাম্যবাদী দৃষ্টির জন্যই তিনি মহান এবং তিনি তার সকল কর্মে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। কবি তাঁর রচনায় ইসলামি গানের অমূল্য এক ভান্ডার উপহার দিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। মাত্র ২৩ বছরের সাধনায় যে সম্পদ সম্ভার মানুষের জন্য তিনি রেখে গেছেন তা পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন আলোকিত করবে মানব জাতিকে। সাহিত্য-সঙ্গীত-নাটক প্রভৃতি চর্চা যতদিন চলবে ততদিন অমর হয়ে থাকবেন তিনি এসবের মাঝে-প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের হৃদয়ে। মানুষ তাকে নিয়ে যত বেশি গবেষণা করবে, যত বেশি চর্চা করবে তার লেখনির-যাদুছোঁয়া সম্ভার, ততো বেশি পাবে বৈচিত্র রঙ-রস ও অসাধারণ তৃপ্তির নির্যাস।

সবশেষে বলতে হয় ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২৫ মে আমাদের জাতীয় কবি ও বিশ্বের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্ম জয়ন্তী। আমরা শুধু কবির জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে দেশব্যাপি অনুষ্ঠানাদি উদযাপন করবো বিভিন্ন কর্মসূচী-অনুষ্ঠানের-এটা ঠিক নয়। এ দিনকে ঘিরে কবির নামে আমাদের মধ্যে এমন সব পদক প্রতিযোগিতা শুরু হবে, যারা প্রকৃতই সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত নয়, তারা পাবে ‘নজরুল পদক’ সম্মাননা তা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমাদের দাবি, বাঙালি জাতি তথা বিশ্বের অহংকার, সমগ্র বিশ্বের গর্ব-মহাকালের মহা কবি নজরুল ইসলামের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী থেকে আমরা শিক্ষা নিই-সত্য, সুন্দর ও আলোকিত মানুষ হওয়ার; জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই কবির জীবনী ও সৃষ্টিশীল কর্মের হোক যথাযথ অনুশীলন। আজকে আমাদের সংকল্প হোক, নজরুলের আদর্শে বলিয়ান হয়ে সকল পঙ্কিলতা মুক্ত উন্নত মানুষ হওয়ার।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও সংগঠক
গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা।



মন্তব্য চালু নেই