অস্বীকার করলেই কি দায় মোচন হয়?

ইতিহাসের বড় শিক্ষা হচ্ছে, ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।’ এমনই অবস্থা হয়েছে বর্তমান পাকিস্তানি নেতৃত্বের। তারা ইতিহাস থেকে তো শিক্ষা নিচ্ছেই না, বরং দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে ইতিহাস, তা অস্বীকার করার দুঃসাহস পর্যন্ত দেখাচ্ছে। তারা একাত্তর সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরপরাধ বাঙালি জনগণের ওপর যে হত্যার তা-বলীলায় মেতে ওঠেছিল, তা এখন অস্বীকার করছে। এটা কি তাদের গোয়ার্তুমি, না জেনে বুঝে সত্যকে অস্বীকার করা?

ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলবের এক সপ্তাহ পর গত ৩০ নভেম্বর ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে পাকিস্তান ’৭১ সালে গণহত্যার দায় অস্বীকার করেছে।

এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিচার এবং সাজা প্রশ্নে পাকিস্তানের বিরোধিতার বিষয়ে ঢাকার অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও অমূলক বলে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা।

ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমান সাংবাদিকদের জানান, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাকে তলব করা হয়। এ সময় তার হাতে প্রতিবাদপত্র তুলে দেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ও সার্ক বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফয়সাল।

ওই প্রতিবাদপত্রে গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া প্রতিবাদপত্রকে ‘ভিত্তিহীন দাবি’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ ছাড়া গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধে মদদ দেওয়ার অভিযোগও পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করেছে।

3_93718_2
একাত্তর সাল কিন্তু বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। সেই সময় বাংলাদেশে কী ঘটেছিল তা সবারই জানা। বিশ্ব মিডিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড়ও হয়েছিল। অনেক বইপত্রও বের হয়েছে, রয়েছে ডকুমেন্টারি। সুতরাং একাত্তর সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান যে অপরাধ করেছিল তা অস্বীকার করলেও তার দায় মোচন হয়ে যায় না।

একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, ২০০২ সালে পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তার বাংলাদেশ সফরের সময় একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে অপরাধ করেছিল তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তিনি সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণও করেছিলেন।

পাকিস্তানে দুবার যাওয়া হয়েছিল আমার। প্রথমবার ২০০৫ সালে দ্বিতীয় দক্ষিণ এশিয়া স্যানিটেশনবিষয়ক সম্মেলনে (সাকোসান) এবং শেষবার ২০০৭ সালে সেখানকার বেসরকারি এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে কয়েকটি সেমিনারে অংশ নেওয়ার জন্য। শেষ সফরে করাচি ও ইসলামাবাদে সম্ভবত দুটি সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম। প্রতিটি সেমিনারেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের বিষয়টি ওঠে আসে।

করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের (পিআইআইএ) উদ্যোগে আয়োজিত সেমিনারে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা কার্যক্রম তুলে ধরার সময় সেখানকার সেই সময়ের এক গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণী নাম সম্ভবত সনম নূর তার এক লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘একাত্তরে নৃশংসতা ও অপকর্মের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার ইস্যুটি এখন সামনে চলে এসেছে।’

তবে এ ব্যাপারে তখন ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন পিআইআইএ’র তখনকার চেয়ারম্যান ফতেহ ইয়াব আলী খান। তিনি বলেছিলেন, ‘একাত্তরের ঘটনার সময় এবং এর আগে পাকিস্তানে নির্বাচিত সরকার বা সাংবিধানিক সরকার ছিল না। যারা ছিলেন তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তথাকথিত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের মাধ্যমে। সুতরাং তখন যা কিছু হয়েছে তার দায়ভার পাকিস্তানের জনগণ নিতে পারে না।’

তবে ইসলামাবাদে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে জং গ্রুপ অব নিউজ পেপারসের উদ্যোগে ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা : চ্যালেঞ্জ ও নিরাপত্তা’ বিষয়ক এক সেমিনারে পাকিস্তানের তখনকার ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান মুসলিম লীগের সেক্রেটারি জেনারেল সিনেটর মুশাহিদ হোসাইন সৈয়দ বলেছিলেন, ‘একাত্তরে কি হয়েছিল তা লুকিয়ে লাভ নেই। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিরা যে নির্যাতন-অত্যাচার করেছে তা ভুল নয়, অপরাধ। বিশ্বে পরিবর্তন হচ্ছে। জাপান তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অপরাধের জন্য চীনের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। এখন পাকিস্তানেরও বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার সময় এসেছে। ক্ষমা চাওয়া দোষের কিছু নয়।’

কয়েকদিন আগেও ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যার ঘটনায় বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন পাকিস্তানের কয়েকজন সংসদ সদস্য। ইন্টারনেটের মাধ্যমে
1_93718_0

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন পাকিস্তানের বিখ্যাত সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী হামিদ মীর। পাকিস্তানের ‘জিইও’ টেলিভিশনের এক্সিকিউটিভ এডিটর হামিদ মীর বলেন, ‘পাকিস্তানের পার্লামেন্টের অন্তত ১২ জন সংসদ সদস্য আমাকে জানিয়েছেন তারা বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব দেবেন।’

মীর বলেন, ‘তারা জানিয়েছেন ইসলামাবাদকে তারা বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে তাড়া দেবেন। একই সঙ্গে তারা সংসদেও এ ব্যাপারে প্রস্তাব পেশ করবেন।’ মীর জানান, এ সব সংসদ সদস্যের মধ্যে বেলুচিস্তানের সিনেটর হাসিল বাজিনজু, পাকিস্তান আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) প্রেসিডেন্ট আসফান্দার ওয়ালী খান, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও মুসলিম লীগ (নওয়াজ) নেতা খাজা সাদ রফিক, পাকিস্তান মুসলিম লীগের নেতা নওশীন সাঈদ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) স্যামস্যাম বুখারিও রয়েছেন।

পাকিস্তান রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান যে গণহত্যা চালিয়েছিল তা অস্বীকার করছেন না। বরং তারা এর জন্য বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে একমত। কিন্তু পাকিস্তানি নেতৃত্ব তা মানতে নারাজ। আমাদের আশা ছিল যে, পাকিস্তানে বর্তমানে যে সরকার রয়েছে, তা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে।

তাই এ সরকার পেছনের সরকারগুলোর মতো আচরণ না করে তাদের জনগণের মনের ভাষা বুঝতে পেরে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু তারা তো ক্ষমা চাইলই না, বরং উল্টো আমাদের দেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদলিপি হস্তান্তর করে বলে দিচ্ছে, তারা একাত্তর সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে গণহত্যা হয়েছিল, তার দায় তাদের নয়। এর চেয়ে নির্জলা মিথ্যা আর কী হতে পারে!



মন্তব্য চালু নেই