অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দীর্ঘস্থায়ী কৌশলী জামায়াত

রাজনৈতিকভাবে দলীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সরকারের সক্রিয় বিরোধিতা না করার পাশাপাশি এককভাবে বড় কর্মসূচি হাতে না নেওয়া। আগামী ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তবে সব কিছুর আগে হাইকোর্টের নির্দেশে নির্বাচন কমিশনে স্থগিত থাকা দলের নিবন্ধন ফিরিয়ে আনাই প্রধান লক্ষ্য এখন জামায়াতের। এ কাজটিকেই নবনির্বাচিত আমির মকবুল আহমাদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে এসব বিষয় উঠে আসে।

গত ১৭ অক্টোবর দলের তৃতীয় আমির হিসেবে নির্বাচিত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন মকবুল আহমাদ। নতুন আমির হিসেবে শপথ নিয়েই দল ও দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। তার ওই বক্তব্যেই জামায়াতের নতুন কৌশল নির্ধারণের ইঙ্গিত মেলে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে অনেকের ফাঁসি কার্যকর হলেও ‘অতীত’কে ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মকবুল আহমাদ।’ তিনি বলেন, ‘একইসঙ্গে অতীতের কোনও রাজনৈতিক বিষয়কে অজুহাত না বানিয়ে সব দুঃখ, কষ্ট ও বেদনাকে ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

নিবন্ধন ফেরানোই নতুন আমিরের প্রধান চ্যালেঞ্জ

হাইকোর্টের রায়ে স্থগিত থাকা নির্বাচন কমিশন থেকে দলের নিবন্ধন ফেরাতে আগ্রহী জামায়াতের নতুন আমির মকবুল আহমাদ। আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চিন্তা থেকেই এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত দলটির। সাংগঠনিক ভিত্তি ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হওয়ায় দলের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন। এক্ষেত্রে দুটি পদ্ধতিতে এগোনোর চিন্তাভাবনা চলছে দলটির নীতি নির্ধারকদের মধ্যে।

প্রথমত, হাইকোর্টে বিচারাধীন বিষয়টি আইনি পথেই মোকাবিলা করা। এ সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো দেশের আইন মেনেই ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করা। চলমান কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ সেক্রেটারিয়েট গঠনের পরই নিবন্ধন নিয়ে আইনি লড়াই শুরু করবে জামায়াত।

দ্বিতীয়ত, সরকার রাজনৈতিকভাবে বা আইনিপথে নিষিদ্ধ করলে সেক্ষেত্রে নতুন নামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে নিবন্ধন পাওয়ার চেষ্টা করা। তবে এ প্রসঙ্গে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার এক প্রভাবশালী সদস্য বলেন, এ নিয়ে সংগঠনের এখনও চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়নি।’ কেন্দ্রীয় এক নেতার এই সহচর বৃহস্পতিবার রাতে জানান, ‘আমরা আইনি পথেই মোকাবিলা করব। আদালতের নির্দেশ, সরকারের মনোভাব; সবকিছু দেখেই আমাদের সিদ্ধান্ত আসবে। আপাতত সাংগঠনিক কাজ চলবে স্বাভাবিকভাবেই।’

এ ব্যাপারে বুধবার রাতে জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও ছাত্র শিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ফরীদ আহমদ রেজা বলেন, নিবন্ধন ছাড়াও একটি দল রাজনৈতিক কর্মসুচি নিতে পারে। হয়তো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন রকম। জামায়াতে ইসলামীকে সরকার কোনও প্রকার ছাড় দিতে না চাইলে নিবন্ধন থাকা না থাকায় কোনও পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারবে না। সরকার না চাইলে তারা নিবন্ধিত হতেও পারবে না।’

বর্তমানে লন্ডনপ্রবাসী সাবেক এই শিবির নেতা আরও বলেন, ‘সরকার যেখানে কাউকেই ছাড় না দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, সেখানে জামায়াতে ইসলামীকে ছাড় দেবে বলে ভাবা যায় না। সরকারবিরোধী আন্দোলনকে গতিশীল করে বিরোধীদের প্রতি সহনশীল হওয়ার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে না পারলে অবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না। রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে পরিবর্তন ছাড়া তাদের জন্য বাংলাদেশে কোনও আশু কোনও রাজনৈতিক সাফল্যের সম্ভাবনা দৃশ্যমান নয়।’

জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল বলেন, ‘সংগঠনকে হ্যান্ডেল করাই মকবুল আহমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। তবে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধিতার যে অভিযোগ উঠেছে, এটি সরকার কিভাবে নেয়, তাও দেখার বিষয়। তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন, তাকে ধরা হয় কিনা, এর ওপর নির্ভর করছে তার সফলতা।’

জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষক হাসান ইকবালের ভাষ্য, ‘বিশ্বের নানান দেশে দীর্ঘমেয়াদি সরকারের শাসনকাল দেখেছে জনগণ। লিবিয়ার গাদ্দাফি, মিশরের হোসনি মোবারকসহ অনেকেই বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকেছেন। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকারও সেই সাইকেলেই আছে। আগামীতে নির্বাচন হলেও সেই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার সহসা কোনও সম্ভাবনা নেই জামায়াতের সামনে।’

জামায়াতের সাবেক এক নেতার আরেক সন্তান মনে করেন, দল হিসেবে জামায়াতের অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে। দল কী করবে? কোনও কর্মসূচি নিতে পারছে না। এক কথাই, কিছুই করতে পারছে না জামায়াত। ফলে, মকবুল আহমাদের ওপর অনেক চ্যালেঞ্জ।

সরকারের সক্রিয় বিরোধিতা করবে না জামায়াত

জামায়াতের একাধিক সূত্র জানায়, এই সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার লড়াইয়ে দল বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না, এমন বিশ্বাস দলটির প্রত্যেক স্তরের নেতাকর্মীদের। এ কারণে সরকারের সক্রিয় বিরোধিতা থেকে দূরে আছে জামায়াত। গত দুই বছর ধরেই সরকারবিরোধী সক্রিয় কর্মসূচি দেয়নি জামায়াত। এমনকি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টন হত্যাকাণ্ড নিয়েও উচ্চবাচ্য করেনি দলটি। গত দুই বছর এ দিনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার ঘোষণা দিলেও কর্মসূচি পালনে দেখা যায়নি জামায়াতকে।

জামায়াতের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় কর্মসূচি থেকে জামায়াত প্রায় দুই বছর ধরেই দূরে আছে। নানা সময় কর্মসূচি দিলেও অনেকটাই ঘরোয়া পারফরম্যান্সে পালিত হয়েছে। ২০১৩ সালে ও ২০১৪ সালে নির্বাচনকেন্দ্রিক নাশকতার পর দলীয় নীতিতে পরিবর্তন আনে জামায়াত। পরের দুই বছর সারা দেশের কোথাও সহিংস কোনও ঘটনা ঘটায়নি দলটির কোনও স্তরের নেতাকর্মীরা। যদিও একাধিকবার কথোপকথনে জামায়াতের একাধিকনেতা এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সংগঠনের গত বছরের জুনে সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ৫৯ তম মুদ্রণে স্থায়ী চারনীতির সর্বশেষ, ‘গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও চরিত্রবান লোকের নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা।’—এ নীতিটিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে।

ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোয় আলোচনা আছে, সারা পৃথিবীতে ইসলামধর্মের নামে সন্ত্রাসী হামলা ও জঙ্গি উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। আগের দুই বছরে নাশকতার পরিচয় পাওয়া দলটিও তাদের রাজনৈতিক নীতিতে পরিবর্তন আনে। ফলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কোনও কর্মকাণ্ডে দেখা যায়নি।

জামায়াত সূত্রের দাবি, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত জামায়াত সক্রিয়ভাবে সরকারবিরোধী কর্মসূচিতে অংশ নেবে না। এর ইঙ্গিত মিলেছে মকবুল আহমাদের শপথগ্রহণপরবর্তী বক্তব্যেও। তিনি বলেছেন, ‘সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে ইসলামের নামে যেকোনও ধরনের চরমপন্থা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। সারা দুনিয়ার সব ধর্মাবলম্বীকে জামায়াতে ইসলামী সম্মান ও মানবিক দৃষ্টিতে দেখে। তাই আমরা রাজনীতি কিংবা ধর্মের নামে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও নিরীহ মানুষ হত্যা এবং জুলুম নির্যতনের অবসান চাই।’

২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেবে জামায়াত

জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার একটি সূত্র দাবি করে, আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পেলেই সরকার নিষেধাজ্ঞা উঠানোর মনোভাব দেখাবে। এক্ষেত্রে বিএনপি-জোট নির্বাচনে আসা-নাআসার দুই সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই এগুচ্ছে জামায়াত। বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জোটের কাছে ১০০ আসনের দাবি করবে দলটি। না হলে এককভাবে নির্বাচনে যাবে জামায়াত।

সূত্রের দাবি, আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজনীতির প্রথম ধাপে অংশ নেবে জামায়াত। স্থানীয় সরকারের গত কয়েকটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে এর কার্যকর মহড়া দিয়েছে দলটি। উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে একাধিকবার প্রার্থী না দেওয়ার অনুরোধ জানালেও নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করে তুলতে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাজ করেছে দলটির নেতাকর্মীরা।

কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন চিকিৎসক সদস্য মনে করছেন, ‘জামায়াত বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকতেই উপজেলা, পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছাড়াই অংশ নিয়েছে। এমনকি বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের সুযোগ থাকলেও সুকৌশলে তা এড়িয়ে গেছেন দলীয় নীতিনির্ধারকরা। এর পেছনে কারণ, অন্য কোনও দলের প্রতীকে নয়, দলীয় বা সাংগঠনিক নির্বাচনি প্রতীকেই নির্বাচনে আগ্রহী জামায়াত। আগামী নির্বাচনেও এর প্রতিফলন দেখা যেতে পারে ।’

খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, ‘সত্যিকার অর্থেই আগামী নির্বাচন থেকে জামায়াত জাতীয় পার্টির ভূমিকায় থাকবে। এদের ভোট যেদিকে যাবে, সরকার গঠন করবে তারাই। সরকারের চেষ্টা থাকবে, বিএনপি-জোট থেকে অন্ততপক্ষে নিবন্ধনের সুযোগ দিয়ে জামায়াতকে ছাড়িয়ে আনা। যদিও জামায়াতের পক্ষ থেকে সব সময়ই জোট ত্যাগ করার বিপক্ষে মত দেওয়া হয়েছে।’

জামায়াতের এক নেতার ধারণা, ‘আগামী যেকোনও সময় জোট ক্ষমতায় গেলে জামায়াতকে মন্ত্রিত্ব দেবে না—এই মনোভাব দলে বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।’

জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদও তার বক্তব্যে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন নেতাকর্মীদের। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কার্যক্রমের সঙ্গে জনগণকে আরও ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করে সংগঠনকে জনগণের দলে পরিণত করতে হবে। জাতীয় সংহতি ও ভৌগলিক অখণ্ডতার চেতনা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।’

জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নিবন্ধন ফেরানোর চেষ্টা আইনিভাবে করা হচ্ছে। এটা চলমান বিচারপ্রক্রিয়া। আর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড আছে। তবে নিবন্ধন না ফিরিয়ে নির্বাচনে তো দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। সময় আসুক, এরপর জানা যাবে।’

নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের শ্রমিক বিভাগের একজন শীর্ষ দায়িত্বশীল বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য জামায়াতের পরিকল্পনা সব সময়ই থাকে। তবে এবার যেহেতু নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই, সেহেতু আইনি পথে নিবন্ধন ফেরানোর চেষ্টা চলবে। তবে তা না হলে নির্বাচনের আগপর্যন্ত সিদ্ধান্ত না এলে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেবে জামায়াত। তবে অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচনে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। একই মনোভাব পোষণ করেন জামায়াতের মহানগর নেতা নুরুল ইসলাম বুলবুলের এক সহচরও।খবর বাংলা ট্রিবিউনের।



মন্তব্য চালু নেই