অযত্নে-অবহেলায় কলারোয়ার পৌনে ৪শ’ বছরের পুরানো পুরাকীর্তি মঠ মন্দির

প্রকৃতির সাথে পুরাকীর্তি যাদের সমানভাবে আকর্ষণ করে তাদের আসতে হবে সাতক্ষীরার কলারোয়ার সীমান্ত জনপদ সোনাবাড়িয়া গ্রামে। মধ্যযুগীয় নানা পুরাকীতির নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে গোটা সোনাবাড়িয়া এলাকা জুড়ে। এমনই এক পুরাকীতির নাম মঠবাড়ি মন্দির গুচ্ছ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কলারোয়া উপজেলা সদর থেকে ৯.৬ কিলোমিটার দূরে সোনাবাড়িয়া গ্রামে এই প্রন্তস্থল টির অবস্থান। প্রায় ৪ শ’ বছরের পুরানো ৬০ ফুট উঁচু টেরাকোটা ফলক খচিত পিরামিড আকৃতির এই মঠ-মন্দির প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই ঐতিহাসিক মঠ-মন্দিরটি এখনই সংরক্ষণ করা না গেলে একটি জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক মোঃ মোশাররফ হোসেনের লেখা ‘প্রত্মতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা’ বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে উল্লেখ করা হয়েছে, এ মন্দির ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করে ছিলেন। যেটি সতীশ চন্দ্র মিত্রের বইয়েও লেখা রয়েছে। এই পুরাকীতির সবচেয়ে বড় এর ত্রিতলবিশিষ্ট নবরত্ম মন্দির। এটিই এলাকায় ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এর সাথে লাগোয়া রয়েছে দুর্গা মন্দির ও শিবমন্দির। এই মন্দির গুচ্ছের দক্ষিণে একটি অসম বাহুবিশিষ্ট চৌকো দিঘি আছে। শ্যামসুন্দর মঠের নিচের তলা ১০.৮২ মি./৩৫ফুট.-৬ ইঞ্চি. বর্গাকার ভিত পরিকল্পনায় নির্মিত। এর দ্বিতলের মাপ ১০ মি./ ৩২ফুট.-১০ ইঞ্চি. ৯.৯৮ মি./ ৩২ ফুট.-৯ ইঞ্চি. এবং ত্রিতল ৭.৪৬মি./ ২৪ ফুট.-৬ ইঞ্চি.৭.১৬ মি./ ২৩ফুট-৬ ইঞ্চি.। ফলে মন্দিরটি একটি পিরামিড আকৃতি ধারণ করেছে। দক্ষিণমুখি এই মন্দিরের নিচের তলার ভিতরের অংশে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা অলিন্দ। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ৬.১৪ মি./ ২০ ফুট.-২ ইঞ্চি.পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এবং ১.৩২ মি./৪ ফুট-৫ ইঞ্চি. চওড়া একটি মন্ডপ। তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে প্রকাষ্ঠ রয়েছে। কিন্তু পূর্বাংশের কোঠাটির পিছনে রয়েছে একটি অলিন্দ, যেখানে দ্বিতল ভবনে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। ধারণা করা যায়, পূর্ব ও পশ্চীম কোঠা দুটিতে সংরক্ষিত মূতির উদ্দেশ্যে মন্দিরটি নিবেদিত ছিল। দ্বিতলে রয়েছে একটি দক্ষিণমুখি কোঠা। এর পরিমাপ ২.২৮ মি./৭ফুট-৬ ইঞ্চি. ১.৯৮মি./৬ ফুট,-৬ ইঞ্চি.। ত্রিতল ভবনটি তুলনামূলক ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়া মাটির ফলক রয়েছে। মোশারফ হোসেনের ওই জরিপ বইয়ে আরো বলা হয়েছে, শ্যামসুন্দর মঠের নিচে রয়েছে ৪৫.৭ সেমি./১ ফুট.-৬ ইঞ্চি. উঁচু নিরেট মঞ্চ। এর প্রত্যেক তলার ছাদপ্রান্ত ধনুকের মত বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধমুখি গম্বুজ রয়েছে। আর মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রত্ম রয়েছে। এটি তাই ‘নবরত্ম স্মৃতি মন্দির’।

নবরত্ম বা শ্যামসুন্দর মঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরও একটি দক্ষিণমুখি মন্দির আছে। এটি ‘দুর্গা মন্দির’ নামে পরিচিত। শ্যামসুন্দর মন্দিরের গা ঘেঁষে পূর্বমুখি মন্দিরটিতে ৯১.৪৩ সেমি./৩ ফুট উঁচু একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। এর ওপর একটি ভাষ্য ফলক পাঠোদ্ধার অনুপযোগী অবস্থায় সংস্থাপিত আছে। এর ছাদ চৌচালা, কার্ণিশ ধনুকাকারে বাঁকা এবং কোণগুলো কৌণিক। এটি ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ নামে পরিচিত। মন্দির গুচ্ছের সব কটি ইমারতে ২২.৮৫ সেমি. ২০.৩১ সেমি. ২.৫৩ সেমি.(৯ ইঞ্চি. ৮ ইঞ্চি. ১ ইঞ্চি.) পরিমাপের ইট ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে। বর্তমানে এ মন্দির গুচ্ছ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই মঠের পাশে আরও ৮ টি (মতান্তরে ১০টি) মন্দির ছিল। অনেকের মতে, রামহংস পরমানন্দ এক সময় মন্দিরগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন। জানা যায়, মঠ মন্দির গুচ্ছের অল্প দক্ষিণে ‘জমির বিশ্বাসের পুকুর’ নামে যে জলাশয়টি আছে তার পাকাঘাটে ব্যবহৃত ইটের সাথে ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ এর ইটের মিল পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা হয় পুকুরটি একই সময় কালের নিদর্শন। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক পুকুরটি বিষমবাহুর আকার ধারণ করেছে।

২০১০ সালের জানুয়ারীতে এই শ্যামসুন্দর মঠ দেখতে সোনাবাড়িয়া ঘুরে গেলেন প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের সাবেক উপ-পরিচালক ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ক লেখক মোঃ মোশাররফ হোসেন। সাথে ছিলেন বিশিষ্ট লেখক জ্যোতির্ময় মলি¬ক এবং খুলনা জাদুঘরের একটি ৭ সদসের টিম। পরিদর্শন কালে তারা ওই এলাকার সংশি¬ষ্ট মানুষের সাথে কথা বলেন। এসময় এলাকাবাসীরা তাদের জানান, প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ মন্দির গুচ্ছের সংরক্ষণের দায়িত্ব নিক-এটাই তারা চান। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো খুলনা জাদুঘরের টিম পরিদর্শনের ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এ মঠ-মন্দিরটি আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মঠটি সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারতো সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ সকল মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।



মন্তব্য চালু নেই