অভিভাবকহীন জাপা!

পাঁচদিনের জন্য অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু পাঁচদিনের সফরে সিঙ্গাপুর অবস্থান করায় দলটির মূল নেতৃত্বে এ শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

জানা গেছে, প্রায় সময় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব অল্পদিনের জন্য দেশের বাইরে গেলে এ সময়ের জন্য দুই শীর্ষ নেতার পদে কাউকেই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার বিধান দলটির গঠনতন্ত্রে রাখা হয়নি। তবে এই দুই নেতা কখনো দীর্ঘ সময়ের জন্য অনুপস্থিত থাকলে সেক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে দলীয় গঠনতন্ত্রে।

এদিকে গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বুধবার দুপুরে দলের জেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব রেজাউল ইসলাম ভুইয়াকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হলেও এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধু¤্রজাল। তাকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করার ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের যে উপধারার কথা বলা হয়েছে, তা-ও ঠিকমত মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ২৩ মার্চ সিঙ্গাপুর চলে যান। যাওয়ার আরো দুদিন পর রেজাউলকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, ২৩ মার্চের দুদিন আগে ২১ মার্চ রেজাউল ভারত সফরে যান। ভারত থেকে তিনি দেশে ফেরেন ২৪ মার্চ রাতে। এ অবস্থায় যদি ২৩ মার্চ থেকেও তাকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়, তাহলে এ সময়ও তিনি দেশে অনুুপস্থিত ছিলেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় কী করে একজন যুগ্ম মহাসচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গঠনতন্ত্র অমান্য করেই যদি কাউকে দায়িত্ব দিতে হয়, তাহলেও রেজাউলের (বিদেশে থাকার কারণে) ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পাওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন দলটির নেতা-কর্মীরা। তাদের দাবি, যেহেতু তিনি দেশে ছিলেন না, তাই তার অনুপস্থিতিতে দলের যুগ্মমহাসচিবদের মধ্য থেকে যে কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা।

এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার দুপুরে রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, ‘গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী আমি ২৩ মার্চ থেকেই ‘ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছি। বিভ্রান্তি দেখা দেওয়ায় দুইদিন পর প্রেসবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। মূলত যেদিন মহাসচিব সিঙ্গাপুর গেছেন ওইদিন থেকেই আমি দায়িত্বে আছি। ’

দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতি ছাড়া জাপার গঠনতন্ত্রে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বিধান নেই, তারপরও কিভাবে দায়িত্ব পালন করছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও মহাসচিব দেশে না থাকলে জাতীয় পার্টি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে- এমন প্রশ্ন ওঠে। সাংবাদিকরাও প্রায় সময় বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করে থাকেন। বিভ্রান্তি নিরসনে গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার উপধারা ৪ এর (ঞ) মোতাবেক আমিই নিয়ম অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছি।’

এতে দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করা হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।

দলের গঠনতন্ত্রে চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ‘দীর্ঘসময়’ ছাড়া অল্পদিনের জন্য বিদেশ অবস্থানকালে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বের বিধান রাখা হয়নি- এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এখন প্রযুক্তির যুগ, বিদেশ থেকেই তিনি মূলত সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন।’ চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে এমন হলে মহাসচিবও তো একই কায়দায় দায়িত্ব পালন করতে পারেন- এমন মন্তব্যের বিষয়টি এড়িয়ে যান রেজাউল ভুঁইয়া।

বুধবার দলের যুগ্ম দপ্তরসম্পাদক আবুল হাসান আহমেদ জুয়েল স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এমপি মেডিক্যাল চেক-আপের জন্য সিঙ্গাপুর অবস্থানকালীন সময়ে দলীয় গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার উপধারা ৪ এর (ঞ) মোতাবেক পার্টির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব-এর দায়িত্ব পালন করবেন।’

অথচ গঠনতন্ত্রের ২০ ধারার যে উপধারার দোহাই দিয়ে রেজাউলকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে তাতে উল্লেখ আছে, ‘তিনি (মহাসচিব) পদাধিকার বলে প্রেসিডিয়ামের সদস্য-সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করিবেন।

তিনি বিদেশে অবস্থান, দীর্ঘ করিলে, অন্য কোনোভাবে মহাসচিবের পদ শূন্য হইলে তদস্থলে যুগ্ম-মহাসচিবের মধ্যে ক্রমানুসারে যিনি জ্যেষ্ঠতায় প্রথমে থাকিবেন তিনি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রয়োজনে পার্টির চেয়ারম্যান প্রেসিডিয়ামের সহিত পরামর্শক্রমে যুগ্ম-মহাসচিবদের মধ্য হইতে অন্য কাহাকেও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিয়োগ করিতে পারিবেন।’

গঠনতন্ত্রের এই ধারার উপধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, মহাসচিব বিদেশ অবস্থান দীর্ঘ করিলে সেক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অথচ মহাসচিব মাত্র পাঁচদিনের জন্য এরশাদের সঙ্গে সিঙ্গাপুর গেছেন। গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে রেজাউলকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে দলের গঠনতন্ত্রই মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মতই ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ নিয়োগের ক্ষেত্রেও পার্টির চেয়ারম্যানের দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিতির কথা বলা আছে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে। এ দীর্ঘ সময়ের অজুহাতে এরশাদের অল্পদিনের বিদেশ অবস্থানকালে জাতীয় পার্টিতে কখনো কাউকেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়নি। অথচ একই অবস্থা (গঠনতন্ত্রমতে, মহাসচিবের দীর্ঘ দিনের অনুপস্থিতি ছাড়াই) অব্যাহত থাকলেও, বুধবার রেজাউলকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দিয়ে দলের গঠনতন্ত্রই অমান্য করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির প্রায় একযুগ মহাসচিব ছিলেন এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার এমপি। তার আমলে কখনই বিদেশ সফরকালে কাউকেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয়নি। একইভাবে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা রওশন এরশাদকেও এরশাদের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

জানা গেছে, মাত্র পাঁচদিনের জন্য দলের এ দুই শীর্ষ নেতা একসঙ্গে বিদেশে অবস্থান করায় দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড ব্যাহত হচ্ছে। কারণ, আসন্ন ডিসিসি নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নিচ্ছে এবং সামনে দলের জাতীয় কাউন্সিলও অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় পার্টিতে চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ছাড়া সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার নজির নেই।

তাছাড়া রেজাউলকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করার বিষয়ে দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সম্মতি রয়েছে কি না- তাও জানা যায়নি। এ নিয়ে খোদ দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাই সংশয় প্রকাশ করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের একজন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের অনুপস্থিতিতে কখনো কাউকে ভারপ্রাপ্ত করা হয়নি। আমার জানা মতে, রেজাউলকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়ার মত কোনো সিদ্ধান্ত দলে হয়নি। এমন কিছু হলে তারা বিদেশ যাওয়ার সময় বলে যেতেন এবং চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে জানানো হত। সিঙ্গপুর যাওয়ার দু’দিন পর তা জানাবেন কেন?’ রেজাউল নিজেই তার অনুগত যুগ্মদপ্তর সম্পাদককে দিয়ে এ কাজ করিয়েছেন বলেও দাবি করেন ওই নেতা।

তবে এরশাদের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায় জানান, মহাসচিবের অনুপস্থিতিতে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে রেজাউল দায়িত্ব পালন করতে পারেন।’



মন্তব্য চালু নেই