অবহেলিত পথ শিশুরা কি সমাজের অভিশাপ?

রাজশাহী : আদর, স্নেহ, ভালোবাস, জড়িয়ে থাকা কথাটির নাম শিশু। সেই শিশুরা আবার অনেক সময় টোকাই বা পিচ্চি নামে পরিচিত হয়। রাজশাহী রেলস্টেশন অতি পরিচিত দৃশ্য, বস্তা হাতে টোকাই বা পথ শিশুদের চলাফেরা। কোনো ট্রেন ছাড়ার আগে ছোট-বড় ব্যাগ নিয়ে ছুটতে দেখা যায় তাদের। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বোতল, পলিথিন, কাগজসহ মানুষের ব্যবহৃত ফেলে দেওয়া জিনিপত্র কুড়ানোই এদের মূল কাজ। খালি গায়ে, খালি পায়ে কিংবা ছেড়া জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ায় এই সব শিশুরা।

রাজশাহী মহানগরীতে দিনে দিনে ছিন্নমূল শিশুদের মিছিল বেড়ে চলেছে। তারা পথ শিশু, হলেও তো তাদের রয়েছে শিক্ষার অধিকার। কিন্তু শিক্ষার আলো কখনও তারা দেখতে পায়না। অনেক সময় তাদের স্কুলে পাঠানোর তেমন আগ্রহ নেই পরিবারের মাঝে। শুধু শিক্ষা নয় তারা বিভিন্ন সময় মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় এসব শিশুদের চোরাচালান ও মাদক বেচাকেনার কাজেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাদের দিয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করানো হয়।

ব্যস্ত নগরীতে কাঁধে একটা একটি ব্যাগ নিয়ে ছুটতে দেখা যায় তাদের বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশনসহ শহরের অলিগলি সব জায়গাতে। কাগজ কুড়ানো কিংবা ভিক্ষা করে চলে তাদের দৈনিন্দন জীবন। মানুষের ধিক্কার চড়-থাপ্পরসহ গালিগালাজ এমনকি শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয় তাদের প্রতিনিয়ত। ওরা যেন সমাজের সর্বোচ্চ অবহেলিত মানুষ। অনেক পথ শিশু মনে করে তারা সমাজের অভিশাপ।

ওদের নিয়ে ভাবনার সময় হয় না কারো। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়সহ সকল পরিস্থিতিতেও ওরা কারো সহানুভূতিটুকুও পায় না কখনও। বেঁচে থাকার জন্য অনেক সময় তারা ঝুকিপূর্ণ কাজ বেছে নেয়। এরপরও যদি কাজ না মিলে পেটের জ্বালায় ওরা বেছে নেয় চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কাজ। সমাজের এসব পথ শিশুরা কারো কাছে ‘টোকাই’ আবার কারো কাছে ‘পিচ্চি’ নামে পরিচিত। রাজশাহীতে এরকম পথ শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার।

অপরদিকে, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) এর পক্ষ থেকে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালা করা হলেও নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হয় নি এসব ছিন্ন মূল শিশুদের। এদের একটি অংশের প্রতিদিন রাত কাটে রাস্তা ও ফুটপাতে। দেশে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে নানা আইন থাকলেও বেড়েই চলছে শিশুশ্রম।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ৩৪ ও ৩৫ অনুযায়ী ১৪ বছরের কোন শিশুকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না। সেখানে আরও বলা হয়েছে শিশুর পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবক শিশুকে দিয়ে কাজ করানোর জন্য কারও সাথে কোনো চুক্তি করতে পারবে না। কিন্তু এইসব নীতিকে পাশ কাটিয়েই শিশুদের নিযুক্ত করা হচ্ছে ঝুকিঁপূর্ণ শ্রমে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে শিশুদের অভিবাবকরাই শিশুদের পড়া লেখা বাদ দিয়ে কাজ করতে পাঠাচ্ছেন।

নগরীর সাগর পাড়া এলাকার ১৪ বছর কিশোর রাজু বলে, বাবার তো অনেক বয়স হয়েছে সে কাজ করতে পারেনা। আমাদের সংসারে বাবা-মা ভাই বোন মিলে ৫জনের সংসার। কাজ করার মতো বলতে আমিই মা বাড়িতে কাজ করে। বড় সংসার বসে থাকা বা লেখা পড়া করলে তো আর সংসার চলবেনা। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে রিকশা চালাতে হচ্ছে। আমি যদি আয় না করি তাহলে হয়তো আমার ছোট ভাই বোনকে না খেয়ে দিন পার করতে হবে।

এরকম আরেক শিশু রাব্বির (১৩) সাথে দেখা হয় রাজশাহী রেলস্টেশনে, তার সাথে কথা বলে জানা যায়, লেখা পড়া করার মত তেমন সুযোগ সে পায় নি। আমার একমাত্র কাজ হল কাগজ কুড়ানো আর রাত হলে ট্রেন যাত্রীদের মালামাল বহন করা। সে বলে আমার পরিবারে তেমন কেউ নেই। কাগজ কুড়িয়ে আর মালপত্র টেনে আমার খাবারের টাকা যোগাড় করি। পড়ালেখা করার বিষয়ে জানতে চাইলে সে বলে, লেখা পড়া তো বড় লোকের ছেলে মেয়েরা করে। পড়াশুনাতো অনেক দূরের কথা আমার থাকার জায়গা টুকুও নেই রাত হলে স্টেশন বা ফুটপাতে শুয়ে থাকি। আমার পড়া লেখা করার অনেক ইচ্ছে কিন্তু কে করাবে বলেন? আর কাজ না করলে খাব কি?

এদিকে নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় আবাসন নির্মাণের কাজে এক শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়। এ ঝুকি পূর্ণ কাজের বিষয়ে জানতে চাইলে সে বলে, ঝুকিপূর্ণ হলেও আমাদের কাজ করতে হয়। আর কাজ না করলে খাবো কি। আমাকে কাজ করে টাকা পেয়ে আমার পরিবারে দিতে হয়। আমার বাবা ১ বছর আগে মারা গেছে সে সময় আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে গোটা পরিবারের দায়িত্ব এখন আমার ওপরে। কোনদিন যদি পড়ালেখা করার সুযোগ পাই তাহলে আবার হয়তো করতে পারি।

এ ব্যাপারে হাড টু রিচ এর সাবেক বিভাগীয় প্রধান হাসিবুল হাসান পল্লব বলেন, জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ অনুসারে ৫ থেকে ১৮ বছরের শিশু কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারবেনা। আর দেশের শ্রম আইন বলছে, ৫ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুশ্রম নিয়োগকর্তার জন্য দন্ডনীয় অপরাধ।

তিনি আরো বলেন, কেবল আইন প্রণয়ন করলেই চলবেনা আইনের প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিত কাজ করতে হবে এবং সরকারের তরফ থেকে এ শিশুদের জন্য করিগরি স্কুল ও তাদের পূর্ণবাসন কেন্দ্র খোলা হলে এ শিশুরা হয়তো অনেক যতেœ বেড়ে উঠতো।



মন্তব্য চালু নেই