অজ্ঞাতনামা : বাংলা সিনেমার নতুন অধ্যায়

রাব্বী আহমেদ : বাংলা সিনেমার চালচ্চিত্রকে ব্যঙ্গ করে বহুদিন আগে জীবনধর্মী সংগীত শিল্পী নচিকেতা গানের সুরে বলেছিলেন,

‘মশলা মুড়ির মত মশলা ছবির যুগে,
কে আর ঝুঁকির পথে যায়!
ভালো ছবি চাই না, হিট হিট ছবি চাই।
এমন কথাই শোনা যায়।’

ঢাকাই চলচ্চিত্রের সাথে যেন ঘুরে ফিরে এই গানের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাই বারবার। বিশেষ করে সিনেমা মানেই যখন চর্বিত-চর্বন কাহিনী, সস্তা বিনোদনমুখর সংলাপ, নকল সুরের গান, টাইপকাস্ট অভিনয়, সেক্স, ভায়োলেন্স আর কাহিনী ও চিত্রায়নের অসামাঞ্জস্যতা। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা সিনেমায় এই অসুস্থ ধারা অব্যাহত ছিল, এখনো রয়েছে। কিন্তু এর মাঝেও যে দু-একটি চলচ্চিত্র আশার আলোর মতো মিটমিট করে জ্বলছে, অন্ধকার-আবর্জনা পেরিয়ে তার ম্রিয়মাণ আলো সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না রুচিশীল দর্শকদের কাছে। যখন বাংলা সিনেমার প্রতি দর্শকদের অনন্ত অনীহা তখন রুচিশীল কাহিনীনির্ভর চলচ্চিত্রগুলো থেকেও দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ছে সিনেমাগুলো। ফলে ভালো বাংলা সিনেমার দারুণ আকাল। কিন্তু এই দুঃসময়েও ভালো বাংলা সিনেমা তৈরি হচ্ছে, এ এক স্বস্তির সংবাদ, যারা সত্যিই বাংলা সিনেমার উন্নতি কামনা করেন তাদের কাছে তো বটেই, বরং যারা হলে গিয়ে ভালো বাংলা সিনেমা দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাদের জন্যও।

সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’। হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়ার মতো মর্মস্পর্শী চলচ্চিত্র ‘অজ্ঞাত নামা’। বাংলা চলচ্চিত্রের সামগ্রিক উন্নতি এখনো যাদের কাছে অজ্ঞাত, যারা বাংলা সিনেমার নাম শুনলেই অস্বস্তি অনুভব করে তাদের কাছে তো বটেই, বরং যারা বাংলা সিনেমা সচারচর হলে দেখতে আগ্রহী তাদের কাছেও সিনেমাটি ভালো লাগবে। একটি ভালো চলচ্চিত্রের জন্য যা কিছু দরকার সবকিছুই ‘অজ্ঞাতনামা’য় পেলাম। কাহিনী, চিত্রনাট্য, নির্মাণশৈলী, অভিনয়শিল্পী, দৃশ্যায়ন, অঙ্গসজ্জা থেকে আবহ সঙ্গীত সবকিছুর মধ্যেই দারুণ সমন্বয় অনুধাবন করি। পুরো সিনেমাটিই একটি মেলানকলিক আবহে ঘেরা। শুরুটা কমেডি ধাঁচের হলেও মূল গল্প ট্রাজিক। সার্থক ট্র্যাজেডির ভেতরে যেমন জীবনের বিচিত্র সব অনুষঙ্গ কমেডির আকারে আসে, তেমনি অজ্ঞাতনামা সিনেমারও পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ব্যথা-বেদনার নিপুণ সব আখ্যান।

সিনেমার শুরুতেই একটি সাদা কবুতর মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় ক্ষেতের পাশে। গ্রামের বৃদ্ধ কেফায়েত উদ্দীন তার নাতিকে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন। ক্ষেতের পাশে পড়ে থাকা সাদা কবুতর দেখে নাতির মনে প্রশ্ন জাগে, মৃত্যু কেন আসে? বৃদ্ধ কেফায়েত উদ্দীন নির্লিপ্ত জবাব দেন, সবই তার ইচ্ছা। এরপর তিনি ও তার নাতি মিলে সেই পাখির লাশক কবর দেন। সিনেমার শুরুতেই কেফায়েত উদ্দীন তাই একটি সংবেদনশীল চরিত্র হিসেবে আমাদের চোখে ধরা দেয়, যিনি হতদরিদ্র সহায়সম্বলহীন এক বৃদ্ধ বাবা। যার সন্তান আছির উদ্দীন মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে গেছে। কেফায়েত উদ্দীন চরিত্রে অভিনয় করেছেন শক্তিমান অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু। সিনেমার প্রারম্ভেই এই দৃশ্যটি বেশ গুরুত্ব বহন করে এবং পুরো সিনেমা সম্পর্কে দর্শকদের ইঙ্গিত দেয়।

কাহিনী পরম্পরায় একদিন পুলিশের ওসি কুদ্দুসের (শতাব্দী ওয়াদুদ) কাছে ওপরের মহল থেকে একটি ফোন আসে। ফোনে জানানো হয়, মধ্যপ্রাচ্যের আজমান শহরে একটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় বাংলাদেশি এক যুবক। যিনি মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়েছিলেন। যুবকের নাম আব্দুল ওয়াহাব। আব্দুল হাকিমের ছেলে। সেই যুবকের লাশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঢাকায় আসার খবর নিয়ে পুলিশের ওসি কুদ্দুস পাশের গ্রামে আব্দুল হাকিমের কাছে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানা যায় আব্দুল হাকিমের ছেলে আব্দুল ওয়াহাব জীবিত। তিনি এখন আর মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইতালির রোমে থাকেন। আরো জানা যায়, রোমে যাওয়ার আগে আব্দুল ওয়াহাবের পাসপোর্ট রমজান দালাল রেখে দেয় এবং রমজান দালাল তা ৩০ হাজার টাকায় কেফায়েত উদ্দীনের ছেলে আছির উদ্দীনের কাছে বিক্রি করে দেয়।

মুহূর্তেই মৃত ব্যক্তির পরিচয় পাল্টে যায়, একই সাথে শোকের মাতমও। আব্দুল ওয়াহাব জীবিত আছে এই খবর তার পিতাকে স্বস্তি এনে দেয় কিন্তু সহায়সম্বলহীন কেফায়েত উদ্দীন তার ছেলে আছির উদ্দীনের মৃত্যুর খবরে বিহ্বল হয়ে পড়েন। শোকে ম্রিয়মাণ হয় তার মা এবং দেশে রেখে যাওয়া স্ত্রীও। জানা যায়, রমজান দালাল (শহীদুজ্জামান সেলিম) গলা কাটা পাসপোর্টে আছির উদ্দীনকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠায়। তাই রমজান দালালের ওপরেই এই ঘটনার দায় পড়ে। ঘটনার দায় এড়াতে কেফায়েত উদ্দীনকে নিয়ে বিদেশ থেকে আগত আছির উদ্দীনের লাশ গ্রহণের জন্য রমজান দালাল ঢাকার পথে রওয়ানা দেয়। ছেলে হারানোর কষ্টে নির্লিপ্ত কেফায়েত উদ্দীন নির্বাক হয়ে পুরো যাত্রা পথে এক ধরণের চাপা কষ্ট অনুভব করেন। লাশের মূল পরিচয় গোপন রাখার জন্য রমজান দালাল কেফায়েত উদ্দীনকে শিখিয়ে দেয় লাশ গ্রহণের সময় সে যেন কাস্টমসের কর্মকর্তার কাছে তার ছেলের নাম আব্দুল ওয়াহাব এবং নিজের নাম আব্দুল হাকিম এই পরিচয় দেয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে কফিন দেখা মাত্রই পুত্র হারানোর কষ্ট জেগে ওঠে কেফায়েত উদ্দীনের মনে। ফলে সে তার ছেলের নাম ধরে বিলাপ করতে থাকেন। ফাঁস হয়ে যায় লাশের আসল পরিচয়।

সে যাত্রায় রমজান দালাল শুল্ক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে বেঁচে যায়। কিন্তু এই লাশ নিয়ে তৈরি হয় একের পর এক বিড়ম্বনা। লাশের সৎকার করতে গিয়ে গ্রামের ইমাম সাহেব টের পান এই লাশের সুন্নতে খৎনা হয়নি। তিনি লাশের পিতা কেফায়েত উদ্দীনকে এই ঘটনা জানাতেই তিনি জানান, তার ছেলের সুন্নতে খৎনা তিনি তিন বছর বয়সেই করেছেন। তাহলে এই লাশটি কার? এমন এক ধুম্রজাল সৃষ্টি হয় সিনেমায়। লাশটি হয়ে যায় ‘অজ্ঞাতনামা’।

এই ঘটনা যেন মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা বহু শ্রমিকের জীবন আখ্যান। যারা মৃত্যুর সময় নিজের পরিচয় নিয়েও মরতে পারে না। মানুষের স্বাভাবিক নাম হারিয়ে একেকজন হয়ে যায় অজ্ঞাতনামা।

‘অজ্ঞাতনামা’ বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো। এমন কাহিনীনির্ভর ছবি নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সিনেমার প্রতি জমে থাকা বিতৃষ্ণার মেঘও কেটে গেছে। বাংলা সিনেমার উন্নতির অজ্ঞাত-অধ্যায় ‘অজ্ঞাতনামা’র মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে নিশ্চিতভাবে। রুচিশীল দর্শকরা আবারো হলমুখী হোক, ‘অজ্ঞাতনামা’ পাক তার প্রাপ্য সম্মান। বাংলা সিনেমা হোক আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকারের অন্য নাম।



মন্তব্য চালু নেই